View project Read more

খেলোয়াড়

রোকেয়া আশা


"মুসা! মুসা!" ইনডোর স্টেডিয়ামটার পুরো গ্যালারি জুড়ে যার নাম শোনা যাচ্ছে সে নিখুঁত রিফ্লেক্সে পরপর দুজন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে পাশ কাটিয়ে বলটাকে ড্রিবলিং করে এগিয়ে যাচ্ছে।
"ড্যানি!" সচেতন হয়ে উঠেছে মুসা আমানের টিমমেট ড্যানিয়েল এরিকসন। মুসার ছুড়ে দেওয়া বল চুম্বকের মত হাতে চলে গেলো তার। হাফ ব্লাড বলা চলে তাকে। মা কৃষ্ণাঙ্গ, বাবা শ্বেতাঙ্গ। এরিকসনের সাদা চামড়া, কালো কোঁকড়া চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা। পরনের লাল জার্সির সাথে ম্যাচ করে মাথায় লাল নিক এর সাইন দেয়া হেডব্যান্ড পরেছে সে। মুসা আমানের মতই আরেক এন বি এ স্টার।
গ্যালারি জুড়ে তখন, "এরিকসন! এরিকসন!" তীব্র চিৎকার। বল হাতে পেয়ে এক মুহূর্ত দেরি করেনি, ছয়ফুট লম্বা দেহটা চোখের পলকে স্প্রিং এর মত লাফিয়ে বাস্কেটের কাছে চলে গেলো। গ্যালারি জুড়ে তখন তুমুল হৈচৈ। এক্ষুণি স্কোরবোর্ডে সংখ্যা বদল হবে। এক.. দুই..
পিনপতন নীরবতা। বাস্কেট নয়, মাটিতে লুটিয়ে পরেছে ড্যানিয়েল এরিকসনের নিস্পন্দ দেহ। দ্রুত মেডিকেল টিম পৌঁছে গেলো কোর্টে। "হি ইজ নো মোর", পালস চেক করে জানালেন মেডিকেল টিমের প্রধান। "অসম্ভব! " পাশ থেকে বললো মার্টিন স্মিথ। এন বি এর আরেক খেলোয়াড়। মুসা তখন হাটু গেড়ে পাশে বসে পরেছে।
"ড্যানির এখন বাস্কেট করার কথা ছিলো, কিভাবে মারা যেতে পারে?" অবাক হয়ে উপস্থিত সবাই তাকালো মুসার দিকে। পেশিবহুল, সুঠাম এই তরুণের চোখে পানি দেখে। এদিকে গ্যালারিতে তখন গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি সেদিনের ম্যাচ পরিত্যাক্ত ঘোষণা করে গ্যালারিতে থাকা সাধারণ দর্শকদের বের করে দেওয়া হলো।

আধ ঘন্টা পর

"আমি লস এঞ্জেলেস টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার রবিন মিলফোর্ড।" স্টেডিয়ামের সিকিউরিটি গার্ডকে নিজের আইডি দেখালো রবিন
"দুখিত স্যার। এখন কাউকে ভেতরে এলাও করা সম্ভব না" বিনীত গলায় জানালো গার্ড। হতাশ চোখে একবার তার দিকে তাকালো রবিন। স্টেডিয়ামের সামনে অনেক নিউজপেপার আর টিভি চ্যানেল থেকেই রিপোর্টার এসেছে। "আমাকে কি এলাও করা সম্ভব?" প্রশ্ন শুনে গার্ড এবং রবিন দুজনেই ফিরে তাকালো। রবিনের মুখে তখন মুচকি হাসি। "কিশোর পাশা ফ্রম সি আই এ।" আইডি বের করে দেখালো তরুণ। মাথা ঝাঁকিয়ে ভেতরে যাওয়ার পথ করে দিলো গার্ড। ভেতরে যাওয়ার আগে সে পেছন ফিরে রবিনের উদ্দেশ্যে বললো, "সন্ধ্যার পর চলে এসো।" "কিন্তু কিশোর...," পুরোটা শেষ করতে পারলোনা রবিন। তার আগেই কিশোর ভেতরে চলে গেছে। হেসে মাথা নাড়লো রবিন। পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রেও কিশোর পাশার জুড়ি মেলা ভার।
"মিস্টার পাশা?" ডাক শুনে ধ্যান ভাঙলো কিশোরের। গভীর মনোযোগে এতক্ষণ ড্যানিয়েল এরিকসনের মৃতদেহ পরীক্ষা করছিলো। অস্বাভাবিক কিছুই পায়নি; খেলতে খেলতে হঠাৎ মারা যাওয়ার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোন রহস্যই নেই। হার্ট এটাক হয়তোবা, কিংবা স্ট্রোক। খেলোয়াড় এবং আগের কোন মেডিকাল কেস নেই বলে এখন হঠাৎ স্ট্রোক হতে পারবেনা এমন কোন কথা নেই।
"স্যার, বডি কি ফরেনসিকে পাঠাবো? " পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো এন্ডি ওয়েস্টমোর। কিশোরের জুনিয়র অফিসার। "হ্যাঁ, পাঠান।" অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিলো কিশোর। এটা খুন হতে পারেনা, সবাই ভাবছে। কিন্তু কিশোর পাশার এত বছরের অভিজ্ঞতা আর ক্ষুরধার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, এরিকসনের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়। উঠে দাঁড়ালো কিশোর। এতক্ষণ বাস্কেটবল কোর্টে এরিকসনের মৃতদেহের পাশে হাটু গেড়ে বসে ছিলো। হাত দিয়ে প্যান্টের হাটুতে লেগে থাকা ধূলো ঝাড়লো। তারপর প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলো দুইহাত। পিঠ টানটান; পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চির মেদহীন ঝরঝরে শরীর। পেশার তাগিদেই নিয়মিত ব্যায়াম করার ফল। পরনে ফর্মাল স্যুট, মাথাভর্তি কোঁকড়া কালো চুল। সুদর্শন, কোন সন্দেহ নেই। ভাবলো এন্ডি। এদিকে কিশোর পাশার তখন মনোযোগ আকর্ষন করেছে গ্যালারিতে বসে থাকা এক তরুণী। এরিকসনের মতই সাদা চামড়া, নীল চোখ, আর নিগ্রোসুলভ কোঁকড়া কালো চুল। কাঁদছে তরুণী। "মিস ব্রুক এরিকসন; ড্যানিয়েল এরিকসনের বোন।" কিশোরকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জানালো এন্ডি। "মিস ওয়েস্টমোর, আপনিও তবে যান এখন। ফরেনসিক রিপোর্ট কালেক্ট করে কল করবেন আমাকে।" নীরবে মাথা ঝাঁকিয়ে কিশোরের কথায় সম্মতি জানিয়ে বের হয়ে গেলো এন্ডি।
"মুসা, চলো যাই।" গ্যালারিতে বসে থাকা মুসাকে উদ্দেশ্য করে বললো কিশোর। এরপর পেছনে ফিরে ফেডারেশনের যারা উপস্থিত ছিলো তাদেরকে খুব নম্রভাবে বললো, "আপনাদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ।" "আপনাকেও ধন্যবাদ মিস্টার প্যাইশা।" হাত বাড়িয়ে দিলেন ফেডারেশন এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মিস্টার বেকহাম। "নো, ইটস পাশা।" মুচকি হেসে হাত মেলালো কিশোর।


অফিসের গাড়িতে এন্ডিকে পাঠিয়ে দিয়েছে, এখন মুসার গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছে কিশোর। রবিনকেও আসতে বলেছে সন্ধ্যার পর। ড্রাইভিং সিটে মুসা, পাশে কিশোর। "মুসা," হঠাৎই জিজ্ঞেস করলো কিশোর, " এরিকসনের ঘাড়ে একটা ট্যাটু ছিলো, নতুন মনে হলো ট্যাটুটাকে; কবে করেছে ওটা জানো?
"ড্যানির ঘাড়ে যে ট্যাটুটা ছিলো? ঠিকই ধরেছো, বেশ নতুন। গত পরশু মাত্র করিয়েছে।" জানালো মুসা। "কোথেকে করেছে জানো?" কিশোরের প্রশ্ন। "ব্রায়াম'স ড্রিংক্স থেকে। বারই বলা চলে, তবে নরমাল ড্রিংক্স ও পাওয়া যায়। ড্রিংক করার অভ্যাস ছিলোনা ড্যানির। ওখানেই তাই যেতো মাঝেমধ্যে। ওটার মালিক ব্রায়াম মিল্ডহার্ড একজন ট্যাটু আর্টিস্ট। কথায় কথায় একদিন জানিয়েছিলো। ওর কাছ থেকেই ড্যানি ট্যাটুটা করিয়েছিলো।" চিন্তিত মুখে শুনছে কিশোর।
"মুসা..।" কিশোর মুখ খুলতেই মৃদু হেসে মুসা বললো, "তুমি প্রশ্ন করতেই বুঝে গেছি আমি, ভালোমতই চিনি তোমাকে। তুমিই খেয়াল করোনি, এটা বাড়ির রাস্তা না।" হাসি ফুটলো কিশোরের মুখে। গাড়িতে বসেই ফোন করে দিয়েছিলো রবিনকে। কিশোর আর মুসা ব্রায়াম'স ড্রিংক্সের সামনে পৌঁছে দেখে নীল রঙের হারলে ডেভিডসন ২৫০ সিসি বাইকটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। সাংবাদিকদের জন্য গাড়ির চেয়ে বাইকটাই বেশী মানানসই, এমনটাই আজকাল তার ধারণা হয়েছে। কিশোরদের দেখেই হাত নাড়লো। এরপর তিন বন্ধু একসাথে বার কাম ক্যাফেটার ভেতরে গেলো। চমৎকার পরিবেশ ভেতরে। এনবিএ স্টারদের জন্য উপযুক্ত জায়গা, ভাবলো কিশোর। "ওই যে,মার্টিন। "দুই বন্ধুকে বললো মুসা। "একাই আছে দেখছি, চলো ওর সাথেই বসি।" "হেই! মুসা!" তিনজন এগিয়ে যেতেই উচ্ছ্বসিত ভাবে মুসাকে জড়িয়ে ধরলো মার্টিন স্মিথ। "ওকে সম্ভবত চেনো তুমি, কিশোর পাশা। ড্যানির কেসটায় আছে এখন।" বললো মুসা। "নিশ্চয়! আর আপনি নিশ্চয় রবিন মিলফোর্ড?" মার্টিনের কথায় হেসে মাথা নাড়লো রবিন। হাত বাড়িয়ে দিলো মার্টিনের দিকে। "মুসা আপনাদের দুজনের কথা প্রায়ই বলে।" কিশোর আর রবিনকে উদ্দেশ্য করে বললো। "মিস্টার আমান?" ডাক শুনে তাকালো তিন গোয়েন্দা। আরেকজন হাফ ব্লাড; কিশোরের চট করে মনে হলো ড্যানিয়েল এরিকসনের সাথে এই তরুণের চেহারার অদ্ভুত মিল।
"আরি ব্রায়াম!" মুসার মুখ হাসিহাসি। এই তাহলে সেই ব্রায়াম, চোখাচোখি হলো কিশোর রবিনের। ফোনে আগেই শুনেছে রবিন। ফোন বেজে উঠলো কিশোরের। এন্ডির ফোন। রিসিভ করে ওপাশের কথা মন দিয়ে শুনলো কিশোর। তারপর দুটো শব্দ উচ্চারণ করলো, কেস ক্লোজড। তারপর ফোন রেখে মুসা আর রবিনকে বললো, "ড্যানিয়েল এরিকসনের মৃত্যুটা হয়েছে হার্ট এটাকে। অস্বাভাবিক কিছুনা এটা। আর ওর ব্লাডেও কোন অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়নি।" অস্বাভাবিকতা বলতে কিশোর কি বোঝাচ্ছে সেটা মুসা আর রবিন বুঝলেও মার্টিন কিংবা ব্রায়াম কেউ বুঝতে পেরেছে বলে ওদের মনে হলোনা। "কেসটা তাহলে ক্লোজ করে দিলে?" রবিনের প্রশ্ন। একগাল হেসে কিশোর বললো, "দুঃখিত সাংবাদিক মশাই, আপনাকে কোন হট নিউজের সন্ধান দিতে পারলাম না।" "আমি তবে কোল্ড ড্রিংক আনবো মিস্টার আমান?" ব্রায়ামের প্রশ্নে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো মুসা, "তিনটে আনবে।" "মি. মার্টিন?" "একটা রাশিয়ান হোয়াইট।" মার্টিন স্মিথের উত্তর। মাথা ঝাঁকিয়ে ড্রিংক্স আনতে রওনা দিলো ব্রায়াম। কিশোর পাশার দৃষ্টি তখন ব্রায়ামের যাওয়ার দিকে; বা হাতের শার্টটা গুটিয়ে রেখেছে কনুইয়ের ওপর, কাজ করার সুবিধার জন্য সাধারণত লোকে ডান হাতের আস্তিন গোটায়। মনে পরলো কিশোরের, এরিকসনের ডান ঘাড়ের ট্যাটুটার কথা। কর্কট আকৃতির ট্যাটুটার শরীরের বা দিকটা বেশী গাঢ় ছিলো। তারমানে ব্রায়াম বাঁহাতি। কিছুক্ষণ পরেই ব্রায়াম গ্লাসভর্তি ট্রে নিয়ে ফিরে এলো। রবিন তখন মার্টিনের সাথে আলাপ জমাতে ব্যস্ত। "তো, মিস্টার স্মিথ.." "মার্টিন ডাকতে পারেন আমাকে, সারনেম ব্যবহার করিনা আমি।" রবিনকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, "আসলে স্মিথ আমার মায়ের দিককার পদবী, তিনি একজন সিংগেল মম ছিলেন।" কিশোরের তখন মনোযোগ ব্রায়ামের হাতের দিকে, ডানহাতেই তো সার্ভ করছে।
"ব্রুকের কি অবস্থা এখন? "ব্রায়ামের হাত থেকে মনোযোগ সরিয়ে প্রশ্ন করলো কিশোর। মুসা এবং মার্টিন উভয়ের উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন। "বাড়িতেই পরে থাকে সারাক্ষণ। কলেজেও যায়না তেমন।" মার্টিনই উত্তর দিলো। "বাড়িতে আর কে আছে?" "ক্লেয়ার থাকে ওখানেই। ওদের হাউজকিপার।" গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে জানালো মার্টিন। "আমি আসছি একটু," বলে বেরিয়ে গেলো কিশোর। হুট করে এই আচরণে মার্টিন বেশ অবাক হলেও রবিন আর মুসা নির্বিকার। কিশোরের এই আচরণে অভ্যস্ত ওরা। কিশোর ফিরে এলো পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। এসে জানালো এন্ডি আসবে কিশোরকে পিক করতে; রবিন আর মুসা চাইলে আসতে পারে।


"রবিন, বাকিটা তোমার হাতে।" কিশোর বললো। মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো রবিন। তারপর এগিয়ে গেলো "এরিকসন'স" লেখা বাড়িটার দিকে। গেটের কাছে পৌঁছে একবার পকেট থেকে ফোন বের করে নিজেকে দেখলো। হাত দিয়ে সোনালি চুলগুলো ঠিক করলো। তারপর চলে গেলো গেটের ঠিক সামনে।
"ব্রুক, তোমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তারপরও, তুমি কি আমার এই বন্ধুকে সাহায্য করতে পারবে?" এরিকসন'স ম্যানশনের বিরাট লিভিং রুমটায় বসে আছে মুসা, রবিন আর ব্রুক। মুসার কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলো ব্রুক। রবিনকে দেখছে। কোন সাংবাদিকের এত সুদর্শন হওয়া উচিৎ না, ভাবলো ব্রুক। "আমি রবিন, রবিন মিলফোর্ড।" মুখে নিজের সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা টেনে মোলায়েম গলায় বললো রবিন। একই সাথে হাত বাড়িয়ে দিলো ব্রুকের দিকে। "ব্রুক এরিকসন।" হাত মেলালো সে। "ক্লেয়ার!" গলা উঁচিয়ে ডাকলো বাড়ির ভেতর দিকে তাকিয়ে। তারপর রবিনদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কফি চলবে? আমাদের বাড়িতে কোন ড্রিংক্স চলেনা।" "ইট'স ওকে। ড্রিংক করিনা আমি।" হেসে বললো রবিন। ভাবছে, মুসা সাথে থাকায় সিকিউরিটির বেড়াজাল পার হয়ে ভেতরে আসা গেছে। পায়ের শব্দ হতে ফিরে তাকালো, হাউজকিপারের সাধারণ মিডল স্কার্ট পরা একটা মেয়ে। বাইশ কি তেইশ চব্বিশ বছর হবে বয়স। গাঢ় নীল চোখ, উজ্জ্বল বাদামী সোজা চুলগুলো কোমরের কাছে পৌঁছে গেছে; মেয়েটিও বেশ লম্বা।
"আরি! মিস্টার আমান যে!" হাসিমুখে মুসাকে অভিবাদন জানালো সুন্দরী। রবিনের দিকে চোখ পড়তেই সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। "আমি রবিন মিলফোর্ড। মুসার বন্ধু। লস এঞ্জেলেস টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার। ড্যানিয়েল এরিকসনের পারিবারিক জীবনের ওপর একটা ফিচার করতে যাচ্ছি আমাদের পত্রিকার জন্য।" "আমি হাভানা ক্লেয়ার, এখানেই কাজ করি।" হাভানাই বটে, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভাবলো রবিন। "ক্লেয়ার, কফি নিয়ে এসো তিনটে।" ব্রুকের কথায় ক্লেয়ারের থেকে মনোযোগ সরিয়ে ব্রুকের দিকে তাকালো রবিন, মুসাও। মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলো ক্লেয়ার। "ব্রুক, যদি কিছু মনে না করো, আমি একবার ড্যানির ঘরে যেতে চাইছি। ওকে মিস করছি খুব...।" বলতে বলতে গলা এলো মুসার। নিচের ঠোঁট কামড়ে নীরবে মাথাটা নামিয়ে নিলো ব্রুক। মুসা উঠে ভেতরের দিকে চলে গেলো।
"এই দেখুন স্যার।" ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা এন্ডি নিজের ট্যাবটা বাড়িয়ে দিলো কিশোরের দিকে। কিশোর পাশেই বসা। এরিকসন'স ম্যানরের বাইরে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে মুসা আর রবিনের জন্য। "বাহ্!" ট্যাবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কিশোর। অবাক হয়ে এন্ডি তাকিয়ে আছে কিশোরের দিকে। এই মানুষটা নিজেই একটা মূর্তিমান বিস্ময়; এন্ডির তাই মনে হয় সবসময়। ফোনের ভাইব্রেশন টের পেতেই প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা বের করে আনলো কিশোর। "বলো ডক্টর।" কিশোরের গলা সিরিয়াস। "আচ্ছা, ঠিক আছে। যা ভেবেছিলাম। আচ্ছা রাখছি।" ফোন কেটে দিলো কিশোর। পুরো রহস্যটাই এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার। দুইয়ে দুইয়ে তাহলে চার, আনমনে মাথা নাড়লো কিশোর।


"আমি হাইস্কুল ফাইনাল দেওয়ার পরের কথা, একটা কার এক্সিডেন্টে আমাদের বাবা-মা দুজনেই একসাথে মারা যায়। ড্যানি তখন সবে মাত্র এন বি এ তে অফার পেয়েছে। ওর প্রথম ম্যাচ ছিলো বাবা মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরের সপ্তাহে। তিন বছর, গত তিনটা বছর ধরে ড্যানিই আমাকে আগলে রেখেছিলো। পৃথিবীর সেরা ভাই ছিলো ও, সাথে পৃথিবীর সেরা সন্তানও।" বলা শেষ করে চোখ মুছলো ব্রুক। স্বান্তনা দেওয়ার জন্য ওর কাঁধে একটা হাত রাখলো রবিন। হাভানা এখানে কফি রেখে মুসাকে কফি দিতে ভেতরে গেছে। ফোনের শব্দে উঠে দাঁড়ালো ব্রুক। বাড়ির ল্যান্ডফোনটা বাজছে। "হ্যালো," ওপাশের কথা শুনলো কিছুক্ষণ। তারপরেই বললো, "ঠিক আছে। আসছি আমি।"
"আমি দুঃখিত, কিন্তু আমাকে এখন একটু বের হতে হবে।" রবিনের দিকে তাকিয়ে বললো ব্রুক। "না, না, ঠিক আছে। মুসা.." বলতে বলতেই রবিন তাকিয়ে দেখে মুসা চলে এসেছে। রবিনের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বোঝালো, সব ঠিক আছে।
এরিকসন'ন ম্যানসন থেকে কালো জাগুয়ারটাকে বের হয়ে যেতে দেখলো কিশোর আর এন্ডি। প্রায় সাথে সাথেই রবিন আর মুসা ছুটে এসে গাড়িতে উঠলো। "কিশোর! গাড়িটাকে ফলো করা দরকার আমাদের। ব্রুক....," উত্তেজিত ভঙ্গিতে রবিন কথাগুলো বলতেই কিশোর তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, "তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। আমি জানি ও কোথায় যাচ্ছে।" শান্তভাবে বললো কিশোর। এন্ডি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কিশোরের দিকে। "এন্ডি, ব্রায়াম'স ড্রিংকে চলো।" প্রশ্ন করতে গিয়েও কিছু বললোনা এন্ডি। কিশোরের সম্বোধন পরিবর্তনে খুশি হয়েছে।


"দরজা বন্ধ," ব্রায়াম'স ড্রিংকের সদর দরজাটা পরীক্ষা করে জানালো এন্ডি। মুচকি হেসে কিশোর পকেট থেকে মাস্টার কী টা বের করলো। হাত সাফাইয়ের বিদ্যাটা ছোটবেলা থেকেই রপ্ত তার। হাইস্কুলের শেষ দিকে তালাখোলার বিদ্যাটাও শিখে নিয়েছে। ভেতরে কাউকে দেখা গেলো না। পার্লারের অন্যপাশে একটা দরজা, সেটার ফাঁক দিয়ে আলো বের হচ্ছে। সম্ভবত এই দরজাটা লাগায়নি। ব্রুকের হাত-পা আর মুখ বেঁধে ঘরের একপাশে ফেলে রাখা হয়েছে, দরজার এপাশ থেকেই ওকে দেখা যাচ্ছে। ব্রায়ামের গলা শোনা গেলো হঠাৎ, "এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই ব্রুক। তোমাকে আমরা খুব যন্ত্রণাহীন ভাবেই মেরে ফেলবো।" আমরা? মানে ব্রায়ামের সাথে আরো কেউ আছে? এন্ডি ভাবছে, সে কে? মিস্টার পাশা ব্রায়ামের প্রোফাইল থেকে ওর ছোটবেলার যে ছবি বের করেছিলো তাতে ব্রায়ামের বয়সী আরেকজন ছিলো। সেই কি? "তোমাকে অন্তত রেপ তো করছেনা কেউ। যত যাই হোক, তুমি আমাদের বোন হও।" চমকে উঠে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালো এন্ডি। ওরা কেউ অবাক হয়নি। না দেখেও বুঝতে পারছে, ব্রুকও ওর মতই চমকে গেছে। পায়ের শব্দ নড়তে শুরু করলো। কিশোর চোখের ইশারা করলো মুসাকে। প্রায় উড়ে গিয়ে ব্রায়ামের বুকে নিজের খুলি দিয়ে আঘাত করলো মুসা, পুরনো মুভ। পেটানো স্বাস্থ্যের নিগ্রো আঘাতটা সহ্য করতে পারলোনা ব্রায়াম। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে পড়ে গেলো নিচে। কিশোর, রবিন আর এন্ডিও ঢুকে পড়েছে। আরেকটা ছায়ামূর্তিকে ছুটে আসতে দেখা গেলো মুসার দিকে, মুহূর্তে চোখাচোখি হয়ে গেলো কিশোর আর রবিনের। ঝট করে বা পায়ের আঙুকে ভর করে ছায়ামূর্তির দিকে ঘুরে গিয়েই ডান পা ছুড়ে মারলো রবিন, শত্রুর কানের পেছনে গিয়ে লাগলো লাথিটা। কারাতের মাওয়াশি গেড়ি। তবে এই শত্রুও কম শক্তিশালী না। টলে পড়তে গিয়েও সামলে নিলো। এক মুহূর্তের টলোমলো অবস্থা। সুযোগটা নিলো কিশোর, দুপাশে হাটু ভাজ করে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলো তলপেটে। এবার আর সামলাতে না পেরে পড়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মুসা বললো, "মার্টিন, তোমার যমজ ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেনা বন্ধু?" মার্টিন প্রচণ্ড আক্রোশ চোখে তাকিয়ে আছে। ঘরের কোণে থাকা ব্রায়াম ওঠার চেষ্টা করতেই কিশোর গর্জে উঠলো, "চুপচাপ যেভাবে আছো সেভাবেই থাকো। নাহলে খুলি উড়িয়ে দেবো।" এরমধ্যেই স্যুটের নিচে থাকা হোলস্টার থেকে রিভলবারটা বের করে এনেছে। কিশোর বাকিদের দিকে তাকাতেই মাথা নেড়ে এন্ডি ব্রুকের বাঁধন খুলতে লেগে গেলো। ঘর থেকে দড়ি পাওয়া গেলো আরো। মুসা আর রবিন চটপট দুইভাইকে বেঁধে ফেললো। "আপনারা না এলে যে আজ কি হতো...." গলা কাঁপছে ব্রুকের। এন্ডি ধরে রেখেছে ওকে। হাত পায়ের বাঁধনের জায়গাটুকুতে রক্তচলাচল স্বাভাবিক হয়নি এখনো। কাঁপছে মেয়েটা। "ওরাই ড্যানিকে খুন করেছে মুসা! আমাকে বলেছে।" "মিস এরিকসন," নরমগলায় বলতে লাগলো কিশোর, "আপনি এখন নিরাপদ, ওদের শাস্তি ওরা পাবে।" মাথা ঝাঁকালো ব্রুক। কিশোরকে আগেও দেখেছে, ড্যানির মৃত্যুর দিন। "ওরা বলছিলো ওরা নাকি আমার আর ড্যানির ভাই হয়।" প্রশ্নের দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকালো ব্রুক। "হ্যাঁ। ব্রায়াম আর মার্টিন যমজ ভাই। ওদের মাকে আপনার বাবা কখনো বিয়ে করেননি। ওদের ছয় বছর বয়সে আপনার মাকে বিয়ে করে ওদের ছেড়ে চলে আসেন তিনি। মিস স্মিথ, অর্থাৎ ওদের মা তখন সিংগেল মা হিসেবে দুই ছেলেকে নিয়ে বিপাকে পড়ে যান। দুজনকেই দেখাশোনা করা সম্ভব ছিলোনা তার পক্ষে। একারনে ব্রায়ামকে তিনি নিজের নিঃসন্তান বড় বোনের কাছে দত্তক দিয়ে দেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে নিয়মিতই যোগাযোগ ছিলো। মার্টিন এন বি এ তে আসার পাঁচ বছর পর ড্যানিয়েলও এন বি এ তে সিলেক্টেড হয়। ব্রায়ামের সাথে ড্যানিয়েলের চেহারার অদ্ভুত মিল দেখে মার্টিনের সন্দেহ হয়। পরে সে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আপনারা ওদের হাফ সিবলিং। কিন্তু আপনাদের বাবা তখন আর বেঁচে নেই। ওরা তখন সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিশোধটা আপনাদের ওপর নেবে।" এই পর্যন্ত বলে থামলো কিশোর। বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এন্ডি আগেই ডিপার্টমেন্টে ফোন করে দিয়েছিলো।


"কনগ্রাচুলেশনস মিস্টার পাশা। ড্যানিয়েল এরিকসনের মার্ডার কেসটা যেভাবে আপনি সমাধান করলেন, ভেরি ইমপ্রেসিভ!" "থ্যাংক ইউ মিসেস নেস্টার।" হাসলো কিশোর। বসে আছে সি আই এর ডিরেক্টর কাওরি নেস্টারের অফিস রুমে। জাপানী বংশোদ্ভূত মহিলা; পঞ্চাশের ওপর বয়স, শক্ত গড়নের, তামাটে গায়ের রঙ। জাপানীসুলভ কালো সোজা চুল আর তীক্ষ্ম কালো চোখ। ধারালো দৃষ্টি। "লস এঞ্জেলেস টাইমসের এই রিপোর্টার আপনাকে সাহায্য করেছে এই কেসে, তাইতো?" লস এঞ্জেলেস টাইমসের একটা কপির কভার পেজের দিকে ইংগিত করলেন। ড্যানিয়েল মার্ডার কেসের ওপর রবিন মিলফোর্ডের একটা রিপোর্ট তাতে। "হ্যাঁ ম্যাম।" মুচকি হাসলো কিশোর। গত পনেরো বছর ধরেই আমরা তিনজন একসাথে বিভিন্ন রহস্যের তদন্ত করে আসছি।" "তিনজন? ও, মুসা আমানের কথাও বলছেন? বাস্কেটবল স্টার?" হেসে মাথা নাড়লো কিশোর। "এরিকসনের ফরেনসিকে প্রথমে কিছুই পাওয়া যায়নি। বুঝলেন কিভাবে বিষ দিয়ে ওকে খুন করা হয়েছে?" "ব্রায়ামের ওখানে যখন গিয়েছিলাম, ওখানে নীল রঙের কিছু আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে সাজানো ছিলো। দেখেই হঠাৎ একোনাইটের কথা মনে পড়ে গেলো আমার। নীল ফুলের গাছ, অথচ মারাত্মক বিষাক্ত। সবচেয়ে বড় কথা, গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি না করলে ভিক্টিমের রক্তে এই বিষটা ধরাও পড়েনা।" "বলে যান।" কেস রিপোর্ট আগেই পড়েছেন ডিরেক্টর নেস্টার। তবুও কিশোরের মুখ থেকেই পুরোটা শুনতে চাইছেন। "ড্যানিয়েলের ঘাড়ের ট্যাটুর মধ্য দিয়ে বিষটা ওর শরীরে ঢোকানো হয়। অথচ ব্রায়াম নিজে বিষটা প্রয়োগ করেনি। একটা ছোট শিশিতে করে একোনাইট মেশানো লিকুইড দিয়ে ড্যানিয়েলকে বলেছিলো ট্যাটু পারফেক্ট করার জন্য ওটা পরে ট্যাটুতে নিডল করতে। ওই শিশিটাই ড্যানিয়েলের ঘর থেকে উদ্ধার করেছিলো মুসা। ব্রায়ামের হাতের ছাপ পাওয়া গেছে ওতে।" "তো আপনারা তিন বন্ধু ছোটবেলা থেকেই গোয়েন্দাগিরি করতেন?" "হ্যাঁ।" হেসে বললো কিশোর, "আমরা তিন গোয়েন্দা।"
Tin Goyenda । তিন গোয়েন্দা


ফারিহা মুসার খালাতো বোন। তার বাবা-মা কাজের জন্য নানা দেশ ভ্রমণ করেন, সে কারণে পড়াশুনা নির্বিঘ্নে চালানোর জন্য মুসার মা তাকে নিজের কাছে এনে রাখেন। তিন গোয়েন্দার চেয়ে বয়সে খানিক ছোট ফারিহার প্রথম আবির্ভাব ভলিউম ২৬ এর 'ঝামেলা' গল্পে। সেও আফ্রিকান বংশোদ্ভুত। শ্যুটিং এ তার দক্ষতা আছে। সে শান্ত, বুদ্ধিমতী এবং মমতাময়ী। গ্রীনহিলসের গল্পগুলোতেই সাধারণত ফারিহাকে পাওয়া যায়। পরে শামসুদ্দিন নওয়াবের কয়েকটা গল্পে তাকে রকি বীচেও পাওয়া গেছে।

ফারিহা আছে এমন ভলিউমের তালিকা

১. ঝামেলা, ভলি ২৬ ২. টক্কর, ভলি ৩৬ ৩. উচ্ছেদ, ভলি ৩৮ ৪. অভিশপ্ত লকেট, ভলি ৪০ ৫. আবার ঝামেলা, ভলি ৪৩ ৬. বড়দিনের ছুটি, বিড়াল উধাও ভলি ৪৫ ৭. নেতা নির্বাচন, ভলি ৪৭ ৮. কবরের প্রহরী, ভলি ৫০ ৯. পেঁচার ডাক, ভলি ৫১ ১০. উড়ো চিঠি, ভলি ৫২ ১১. রহস্যের খোঁজে, ভলি ৫৫ ১২. হারজিত, ভলি ৫৬ ১৩. মোমের পুতুল, ভলি ৫৮ ১৪. চোরের আস্তানা, ভলি ৫৯ ১৫. বিড়ালের অপরাধ, ভলি ৬৫ ১৬. পার্কে বিপদ, ভলি ৭০ ১৭. ভিনদেশী রাজকুমার, ভলি ৭২ ১৮. চ্যাম্পিয়ান গোয়েন্দা, ভলি ৭৭ ১৯. উড়ন্ত রবিন, ভলি ৯৩ ২০. রুদ্রসাগর, ভলি ৯৯ ২১. লাটসাহেব, ভলি ১০৬/২